হৈমন্তী (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)


কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন,
কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন
না। তিনি দেখিলেন , মেয়েটির
বিবাহের বয়স পার হইয়া গেছে , কিন্তু
আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা
অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার
সময়টাও পার হইয়া যাইবে । মেয়ের বয়স
অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে , কিন্তু
পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো
তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরে আছে ,
সেইজন্যই তাড়া।
আমি ছিলাম বর, সুতরাং
বিবাহসম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা
অনাবশ্যক ছিল। আমার কাজ আমি
করিয়াছি , এফ.এ. পাস করিয়া বৃত্তি
পাইয়াছি। তাই প্রজাপতির দুই পক্ষ ,
কন্যাপক্ষ ও বরপক্ষ, ঘন ঘন বিচলিত হইয়া
উঠিল।
আমাদের দেশে যে মানুষ একবার বিবাহ
করিয়াছে বিবাহ সম্বন্ধে তাহার মনে
আর কোনো উদ্বেগ থাকে না।
নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের
সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, স্ত্রীর
সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া
উঠে । অবস্থা যেমনি ও বয়স যতই হউক,
স্ত্রীর অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ
করিয়া লইতে তাহার কোনো দ্বিধা
থাকে না। যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে
দেখি আমাদের নবীন ছাত্রদের ।
বিবাহের পৌনঃপুনিক প্রস্তাবে
তাহাদের পিতৃপক্ষের পাকা চুল কলপের
আশীর্বাদে পুনঃপুনঃ কাঁচা হইয়া উঠে
, আর প্রথম ঘটকালির আঁচেই ইহাদের
কাঁচা চুল ভাবনায় একরাত্রে পাকিবার
উপক্রম হয়।
সত্য বলিতেছি , আমার মনে এমন বিষম
উদ্বেগ জন্মে নাই । বরঞ্চ বিবাহের
কথায় আমার মনের মধ্যে যেন দক্ষিনে
হাওয়া দিতে লাগিল। কৌতূহলী
কল্পনার কিশলয়গুলির মধ্যে একটা যেন
কানাকানি পড়িয়া গেল । যাহাকে
বার্কের ফ্রেঞ্চ্ রেভোল্যুশনের নোট
পাঁচ-সাত খাতা মুখস্থ করিতে হইবে ,
তাহার পক্ষে এ ভাবটা দোষের । আমার
এ লেখা যদি টেক্স্ট্বুক্-কমিটির
অনুমোদিত হইবার কোনো আশঙ্কা
থাকিত তবে সাবধান হইতাম।
কিন্তু , এ কী করিতেছি । এ কি একটি
গল্প যে উপন্যাস লিখিতে বসিলাম ।
এমন সুরে আমার লেখা শুরু হইবে এ আমি
কি জানিতাম। মনে ছিল , কয় বৎসরের
বেদনার যে মেঘ কালো হইয়া জমিয়া
উঠিয়াছে , তাহাকে বৈশাখসন্ধ্যার
ঝোড়ো বৃষ্টির মতো প্রবল বর্ষণে
নিঃশেষ করিয়া দিব । কিন্তু , না
পারিলাম বাংলায় শিশুপাঠ্য বই
লিখিতে , কারণ, সংস্কৃত মুগ্ধবোধ
ব্যাকরণ আমার পড়া নাই; আর, না
পারিলাম কাব্য রচনা করিতে , কারণ
মাতৃভাষা আমার জীবনের মধ্যে এমন
পুষ্পিত হইয়া উঠে নাই যাহাতে
নিজের অন্তরকে বাহিরে টানিয়া
আনিতে পারি । সেইজন্যেই
দেখিতেছি , আমার ভিতরকার
শ্মশানচারী সন্ন্যাসীটা অট্টহাস্যে
আপনাকে আপনি পরিহাস করিতে
বসিয়াছে। না করিয়া করিবে কী।
তাহার যে অশ্রু শুকাইয়া গেছে।
জ্যৈষ্ঠের খররৌদ্রই তো জ্যৈষ্ঠের
অশ্রুশূন্য রোদন।
আমার সঙ্গে যাহার বিবাহ হইয়াছিল
তাহার সত্য নামটা দিব না। কারণ ,
পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার নামটি
লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে
বিবাদের কোনো আশঙ্কা নাই। যে
তাম্রশাসনে তাহার নাম খোদাই করা
আছে সেটা আমার হৃদয়পট ।
কোনোকালে সে পট এবং সে নাম
বিলুপ্ত হইবে , এমন কথা আমি মনে
করিতে পারি না । কিন্তু , যে
অমৃতলোকে তাহা অক্ষয় হইয়া রহিল
সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগোনা
নাই।
আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক
একটা নাম চাই। আচ্ছা , তাহার নাম
দিলাম শিশির। কেননা, শিশিরে
কান্নাহাসি একেবারে এক হইয়া আছে ,
আর শিশিরে ভোরবেলাটুকুর কথা
সকালবেলায় আসিয়া ফুরাইয়া যায়।
শিশির আমার চেয়ে কেবল দুই বছরের
ছোটো ছিল । অথচ , আমার পিতা যে
গৌরীদানের পক্ষপাতী ছিলেন না
তাহা নহে।
তাঁহার পিতা ছিলেন উগ্রভাবে
সমাজবিদ্রোহী, দেশের প্রচলিত
ধর্মকর্ম কিছুতে তাঁহার আস্থা ছিল না;
তিনি কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন।
আমার পিতা উগ্রভাবে সমাজের
অনুগামী ; মানিতে তাঁহার বাধে এমন
জিনিস আমাদের সমাজে , সদরে বা
অন্দরে , দেউড়ি বা খিড়কির পথে
খুঁজিয়া পাওয়া দায়, কারণ, ইনিও
কষিয়া ইংরাজি পড়িয়াছিলেন।
পিতামহ এবং পিতা উভয়েরই মতামত
বিদ্রোহের দুই বিভিন্ন মূর্তি।
কোনোটাই সরল স্বাভাবিক নহে। তবুও
বড়ো বয়সের মেয়ের সঙ্গে বাবা যে
আমার বিবাহ দিলেন তাহার কারণ,
মেয়ের বয়স বড়ো বলিয়াই পণের
অঙ্কটাও বড়ো। শিশির আমার শ্বশুরের
একমাত্র মেয়ে। বাবার বিশ্বাস ছিল ,
কন্যার পিতার সমস্ত টাকা ভাবী
জামাতার ভবিষ্যতের গর্ভ পূরণ করিয়া
তুলিতেছে।
আমার শ্বশুরের বিশেষ কোনো-একটা
মতের বালাই ছিল না। তিনি পশ্চিমের
এক পাহাড়ের কোনো রাজার অধীনে
বড়ো কাজ করিতেন। শিশির যখন
কোলে তখন তাহার মার মৃত্যু হয়। মেয়ে
বৎসর-অন্তে এক-এক বছর করিয়া বড়ো
হইতেছে , তাহা আমার শ্বশুরের
চোখেই পড়ে নাই। সেখানে তাঁহার
সমাজের লোক এমন কেহই ছিল না যে
তাঁহাকে চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া
দিবে।
শিশিরের বয়স যথাসময়ে ষোলো হইল;
কিন্তু সেটা স্বভাবের ষোলো,
সমাজের ষোলো নহে। কেহ তাহাকে
আপন বয়সের জন্য সতর্ক হইতে পরামর্শ
দেয় নাই, সেও আপন বয়সটার দিকে
ফিরিয়াও তাকাইত না।
কলেজে তৃতীয় বৎসরে পা দিয়াছি,
আমার বয়স উনিশ, এমন সময় আমার
বিবাহ হইল। বয়সটা সমাজের মতে বা
সমাজসংস্কারকের মতে উপযুক্ত কি না
তাহা লইয়া তাহারা দুই পক্ষ লড়াই
করিয়া রক্তারক্তি করিয়া মরুক, কিন্তু
আমি বলিতেছি, সে বয়সটা পরীক্ষা
পাস করিবার পক্ষে যত ভালো হউক
বিবাহের সম্বন্ধ আসিবার পক্ষে
কিছুমাত্র কম ভালো নয়।
বিবাহের অরুণোদয় হইল একখানি
ফোটোগ্রাফের আভাসে। পড়া মুখস্থ
করিতেছিলাম। একজন ঠাট্টার
সম্পর্কের আত্মীয়া আমার টেবিলের
উপরে শিশিরের ছবিখানি রাখিয়া
বলিলেন, “এইবার সত্যিকার পড়া পড়ো
— একেবারে ঘাড়মোড় ভাঙিয়া।”
কোনো একজন আনাড়ি কারিগরের
তোলা ছবি। মা ছিল না, সুতরাং কেহ
তাহার চুল টানিয়া বাঁধিয়া, খোঁপায়
জরি জড়াইয়া, সাহা বা মল্লিক
কোম্পানির জবড়জঙ জ্যাকেট পরাইয়া,
বরপক্ষের চোখ ভুলাইবার জন্য
জালিয়াতির চেষ্টা করে নাই। ভারি
একখানি সাদাসিধা মুখ, সাদাসিধা
দুটি চোখ, এবং সাদাসিধা একটি শাড়ি
। কিন্তু , সমস্তটি লইয়া কী যে মহিমা
সে আমি বলিতে পারি না। যেমন-
তেমন একখানি চৌকিতে বসিয়া,
পিছনে একখানা ডোরা-দাগ-কাটা
শতরঞ্চ ঝোলানো, পাশে একটা
টিপাইয়ের উপরে ফুলদানিতে ফুলের
তোড়া। আর, গালিচার উপরে শাড়ির
বাঁকা পাড়টির নীচে দুখানি খালি
পা।
পটের ছবিটির উপর আমার মনের সোনার
কাঠি লাগিতেই সে আমার জীবনের
মধ্যে জাগিয়া উঠিল। সেই কালো দুটি
চোখ আমার সমস্ত ভাবনার মাঝখানে
কেমন করিয়া চাহিয়া রহিল। আর , সেই
বাঁকা পাড়ের নীচেকার দুখানি খালি
পা আমার হৃদয়কে আপন পদ্মাসন করিয়া
লইল।
পঞ্জিকার পাতা উল্ টাইতে থাকিল;
দুটা-তিনটা বিবাহের লগ্ন পিছাইয়া
যায়, শ্বশুরের ছুটি আর মেলে না। ও
দিকে সামনে একটা অকাল চার-পাঁচটা
মাস জুড়িয়া আমার আইবড় বয়সের
সীমানাটাকে উনিশ বছর হইতে অনর্থক
বিশ বছরের দিকে ঠেলিয়া দিবার
চক্রান্ত করিতেছে। শ্বশুরের এবং
তাঁহার মনিবের উপর রাগ হইতে
লাগিল।
যা হউক, অকালের ঠিক পূর্বলগ্নটাতে
আসিয়া বিবাহের দিন ঠেকিল।
সেদিনকার সানাইয়ের প্রত্যেক তানটি
যে আমার মনে পড়িতেছে। সেদিনকার
প্রত্যেক মুহূর্তটি আমি আমার সমস্ত
চৈতন্য দিয়া স্পর্শ করিয়াছি। আমার
সেই উনিশ বছরের বয়সটি আমার জীবনে
অক্ষয় হইয়া থাক্।
বিবাহসভায় চারি দিকে হট্টগোল ;
তাহারই মাঝখানে কন্যার কোমল
হাতখানি আমার হাতের উপর পড়িল।
এমন আশ্চর্য
আর কী আছে। আমার মন বারবার
করিয়া বলিতে লাগিল, ‘ আমি পাইলাম
, আমি ইহাকে পাইলাম। '
কাহাকে পাইলাম। এ যে দুর্লভ, এ যে
মানবী, ইহার রহস্যের কি অন্ত আছে।
আমার শ্বশুরের নাম গৌরীশংকর। যে
হিমালয়ে বাস করিতেন সেই
হিমালয়ের তিনি যেন মিতা। তাঁহার
গাম্ভীর্যের শিখরদেশে একটি স্থির
হাস্য শুভ্র হইয়াছিল। আর, তাঁহার
হৃদয়ের ভিতরটিতে স্নেহের যে-একটি
প্রস্রবণ ছিল তাহার সন্ধান যাহারা
জানিত তাহারা তাঁহাকে ছাড়িতে
চাহিত না।
কর্মক্ষেত্রে ফিরিবার পূর্বে আমার
শ্বশুর আমাকে ডাকিয়া বলিলেন, “
বাবা , আমার মেয়েটিকে আমি
সতেরো বছর ধরিয়া জানি , আর
তোমাকে এই ক ' টি দিন মাত্র
জানিলাম , তবু তোমার হাতেই ও রহিল
। যে ধন দিলাম, তাহার মূল্য যেন
বুঝিতে পার , ইহার বেশি আশীর্বাদ
আর নাই। ”
তাঁহার বেহাই বেহান সকলেই
তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস
দিয়া বলিলেন, “ বেহাই , মনে কোনো
চিন্তা রাখিয়ো না। তোমার মেয়েটি
যেমন বাপকে ছাড়িয়া আসিয়াছে
এখানে তেমনি বাপ মা উভয়কেই পাইল।

তাহার পরে শ্বশুরমশায় মেয়ের কাছে
বিদায় লইবার বেলা হাসিলেন;
বলিলেন , “ বুড়ি, চলিলাম। তোর
একখানি মাত্র এই বাপ , আজ হইতে
ইহার যদি কিছু খোওয়া যায় বা চুরি
যায় বা নষ্ট হয় আমি তাহার জন্য দায়ী
নই। ”
মেয়ে বলিল, “ তাই বৈকি । কোথাও
একটু যদি লোকসান হয় তোমাকে তার
ক্ষতিপূরণ করিতে হইবে। ”
অবশেষে নিত্য তাঁহার যে-সব বিষয়ে
বিভ্রাট ঘটে বাপকে সে সম্বন্ধে সে
বার বার সতর্ক করিয়া দিল।
আহারসম্বন্ধে আমার শ্বশুরের যথেষ্ট
সংযম ছিল না, গুটিকয়েক অপথ্য ছিল ,
তাহার প্রতি তাঁহার বিশেষ আসক্তি
— বাপকে সেই-সমস্ত প্রলোভন হইতে
যথাসম্ভব ঠেকাইয়া রাখা মেয়ের এক
কাজ ছিল। তাই আজ সে বাপের হাত
ধরিয়া উদ্বেগের সহিত বলিল, “ বাবা ,
তুমি আমার কথা রেখো — রাখবে ?”
বাবা হাসিয়া কহিলেন, “ মানুষ পণ
করে পণ ভাঙিয়া ফেলিয়া হাঁফ
ছাড়িবার জন্য, অতএব কথা না-দেওয়াই
সব চেয়ে নিরাপদ। ”
তাহার পরে বাপ চলিয়া আসিলে ঘরে
কপাট পড়িল। তাহার পরে কী হইল কেহ
জানে না।
বাপ ও মেয়ের অশ্রুহীন বিদায়ব্যাপার
পাশের ঘর হইতে কৌতূহলী
অন্তঃপুরিকার দল দেখিল ও শুনিল ।
অবাক কাণ্ড! খোট্টার দেশে থাকিয়া
খোট্টা হইয়া গেছে! মায়ামমতা
একেবারে নাই!
আমার শ্বশুরের বন্ধু বনমালীবাবুই
আবাদের বিবাহের ঘটকালি
করিয়াছিলেন । তিনি আমাদের
পরিবারেরও পরিচিত । তিনি আমার
শ্বশুরকে বলিয়াছিলেন , “ সংসারে
তোমার তো ঐ একটি মেয়ে । এখন
ইহাদেরই পাশে বাড়ি লইয়া এইখানেই
জীবনটা কাটাও।”
তিনি বলিলেন, “ যাহা দিলাম তাহা
উজাড় করিয়াই দিলাম । এখন ফিরিয়া
তাকাইতে গেলে দুঃখ পাইতে হইবে ।
অধিকার ছাড়িয়া দিয়া অধিকার
রাখিতে যাইবার মতো এমন বিড়ম্বনা
আর নাই।”
সব-শেষে আমাকে নিভৃতে লইয়া গিয়া
অপরাধীর মতো সসংকোচে বলিলেন, “
আমার মেয়েটির বই পড়িবার শখ , এবং
লোকজনকে খাওয়াইতে ও বড়ো
ভালোবাসে । এজন্য বেহাইকে বিরক্ত
করিতে ইচ্ছা করি না । আমি মাঝে
মাঝে তোমাকে টাকা পাঠাইব ।
তোমার বাবা জানিতে পারিলে কি
রাগ করিবেন।”
প্রশ্ন শুনিয়া কিছু আশ্চর্য হইলাম ।
সংসারে কোনো-একটা দিক হইতে
অর্থসমাগম হইলে বাবা রাগ করিবেন ,
তাঁহার মেজাজ এত খারাপ তো দেখি
নাই।
যেন ঘুষ দিতেছেন, এমনিভাবে আমার
হাতে একখানা একশো টাকার নোট
গুঁজিয়া দিয়াই আমার শ্বশুর দ্রুত
প্রস্থান করিলেন; আমার প্রণাম লইবার
জন্য সবুর করিলেন না। পিছন হইতে
দেখিতে পাইলাম , এইবার পকেট হইতে
রুমাল বাহির হইল ।
আমি স্তব্ধ হইয়া বসিয়া ভাবিতে
লাগিলাম । মনে বুঝিলাম , ইহারা অন্য
জাতের মানুষ।
বন্ধুদের অনেককেই তো বিবাহ করিতে
দেখিলাম । মন্ত্র পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই
স্ত্রীটিকে একেবারে এক গ্রাসে
গলাধঃকরণ করা হয় । পাকযন্ত্রে
পৌঁছিয়া কিছুক্ষণ বাদে এই পদার্থটির
নানা গুণাগুণ প্রকাশ হইতে পারে এবং
ক্ষণে ক্ষণে আভ্যন্তরিক উদ্বেগ
উপস্থিত হইয়াও থাকে , কিন্তু
রাস্তাটুকুতে কোথাও কিছুমাত্র বাধে
না । আমি কিন্তু বিবাহসভাতেই
বুঝিয়াছিলাম , দানের মন্ত্রে স্ত্রীকে
যেটুকু পাওয়া যায় তাহাতে সংসার
চলে , কিন্তু পনেরো-আনা বাকি
থাকিয়া যায় । আমার সন্দেহ হয় ,
অধিকাংশ লোকে স্ত্রীকে
বিবাহমাত্র করে , পায় না, এবং
জানেও না যে পায় নাই ; তাহাদের
স্ত্রীর কাছেও আমৃত্যুকাল এ খবর ধরা
পড়ে না । কিন্তু , সে যে আমার
সাধনার ধন ছিল ; সে আমার সম্পত্তি
নয় , সে আমার সম্পদ ।
শিশির — না , এ নামটা আর ব্যবহার
করা চলিল না । একে তো এটা তাহার
নাম নয় , তাহাতে এটা তাহার পরিচয়ও
নহে । সে সূর্যের মতো ধ্রুব ; সে
ক্ষণজীবিনী উষার বিদায়ের
অশ্রুবিন্দুটি নয় । কী হইবে গোপনে
রাখিয়া। তাহার আসল নাম হৈমন্তী।
দেখিলাম , এই সতেরো বছরের
মেয়েটির উপরে যৌবনের সমস্ত আলো
আসিয়া পড়িয়াছে , কিন্তু এখনো
কৈশোরের কোল হইতে সে জাগিয়া
উঠে নাই । ঠিক যেন শৈলচূড়ার বরফের
উপর সকালের আলো ঠিকরিয়া
পড়িয়াছে , কিন্তু বরফ এখনো গলিল না
। আমি জানি , কী অকলঙ্ক শুভ্র সে , কী
নিবিড় পবিত্র ।
আমার মনে একটা ভাবনা ছিল যে ,
লেখাপড়া-জানা বড়ো মেয়ে , কী
জানি কেমন করিয়া তাহার মন পাইতে
হইবে । কিন্তু, অতি অল্পদিনেই
দেখিলাম , মনের রাস্তার সঙ্গে বইয়ের
দোকানের রাস্তার কোনো জায়গায়
কোনো কাটাকাটি নাই । কবে যে
তাহার সাদা মনটির উপরে একটু রঙ
ধরিল , চোখে একটু ঘোর লাগিল, কবে যে
তাহার সমস্ত শরীর মন যেন উৎসুক হইয়া
উঠিল, তাহা ঠিক করিয়া বলিতে
পারিব না।
এ তো গেল এক দিকের কথা । আবার অন্য
দিকও আছে , সেটা বিস্তারিত বলিবার
সময় আসিয়াছে ।
রাজসংসারে আমার শ্বশুরের চাকরি ।
ব্যাঙ্কে যে তাঁহার কত টাকা জমিল
সে সম্বন্ধে জনশ্রুতি নানাপ্রকার
অঙ্কপাত করিয়াছে , কিন্তু কোনো
অঙ্কটাই লাখের নীচে নামে নাই ।
ইহার ফল হইয়াছিল এই যে , তাহার
পিতার দর যেমন-যেমন বাড়িল হৈমর
আদরও তেমনি বাড়িতে থাকিল ।
আমাদের ঘরের কাজকর্ম রীতিপদ্ধতি
শিখিয়া লইবার জন্য সে ব্যগ্র , কিন্তু
মা তাহাকে অত্যন্ত স্নেহে কিছুতেই
হাত দিতে দিলেন না । এমন-কি , হৈমর
সঙ্গে পাহাড় হইতে যে দাসী
আসিয়াছিল যদিও তাহাকে নিজেদের
ঘরে ঢুকিতে দিতেন না তবু তাহার
জাত সম্বন্ধে প্রশ্নমাত্র করিলেন না ,
পাছে বিশ্রী একটা উত্তর শুনিতে হয় ।
এমনিভাবেই দিন চলিয়া যাইতে পরিত
, কিন্তু হঠাৎ একদিন বাবার মুখ ঘোর
অন্ধকার দেখা গেল । ব্যাপারখানা এই
— আমার বিবাহে আমার শ্বশুর পনেরো
হাজার টাকা নগদ এবং পাঁচ হাজার
টাকার গহনা দিয়াছিলেন । বাবা
তাঁহার এক দালাল বন্ধুর কাছে খবর
পাইয়াছেন , ইহার মধ্যে পনেরো
হাজার টাকাই ধার করিয়া সংগ্রহ
করিতে হইয়াছে, তাহার সুদও নিতান্ত
সামান্য নহে । লাখ টাকার গুজব তো
একেবারেই ফাঁকি ।
যদিও আমার শ্বশুরের সম্পত্তির
পরিমাণ সম্বন্ধে আমার বাবার সঙ্গে
তাঁহার কোনোদিন কোনো আলোচনাই
হয় নাই , তবু বাবা জানি না, কোন্
যুক্তিতে ঠিক করিলেন , তাঁহার বেহাই
তাঁহাকে ইচ্ছাপূর্বক প্রবঞ্চনা
করিয়াছেন।
তার পরে , বাবার একটা ধারণা ছিল ,
আমার শ্বশুর রাজার প্রধান মন্ত্রী-
গোছের একটা-কিছু । খবর লইয়া
জানিলেন , তিনি সেখানকার
শিক্ষাবিভাগের অধ্যক্ষ। বাবা
বলিলেন , অর্থাৎ ইস্কুলের হেড্ মাস্টার
— সংসারে ভদ্র পদ যতগুলো আছে
তাহার মধ্যে সব চেয়ে ওঁচা। বাবার
বড়ো আশা ছিল , শ্বশুর আজ বাদে কাল
যখন কাজে অবসর লইবেন তখন আমিই
রাজমন্ত্রী হইব।
এমন সময়ে রাস-উপলক্ষে দেশের
কুটুম্বরা আমাদের কলিকাতার বাড়িতে
আসিয়া জমা হইলেন। কন্যাকে
দেখিয়া তাঁহাদের মধ্যে একটা
কানাকানি পড়িয়া গেল । কানাকানি
ক্রমে অস্ফুট হইতে স্ফুট হইয়া উঠিল। দূর
সম্পর্কের কোনো-এক দিদিমা বলিয়া
উঠিলেন, “পোড়া কপাল আমার! নাতবউ
যে বয়সে আমাকেও হার মানাইল। ”
আর-এক দিদিমাশ্রেণীয়া বলিলেন, “
আমাদেরই যদি হার না মানাইবে তবে
অপু বাহির হইতে বউ আনিতে যাইবে
কেন। ”
আমার মা খুব জোরের সঙ্গে বলিয়া
উঠিলেন, “ ওমা , সে কি কথা । বউমার
বয়স সবে এগারো বৈ তো নয় , এই আসছে
ফাল্গুনে বারোয় পা দিবে । খোট্টার
দেশে ডালরুটি খাইয়া মানুষ, তাই অমন
বাড়ন্ত হইয়া উঠিয়াছে। ”
দিদিমারা বলিলেন, “ বাছা , এখনো
চোখে এত কম তো দেখি না। কন্যাপক্ষ
নিশ্চয়ই তোমাদের কাছে বয়স
ভাঁড়াইয়াছে।”
মা বলিলেন, “ আমরা যে কুষ্ঠি
দেখিলাম। ”
কথাটা সত্য। কিন্তু কোষ্ঠীতেই প্রমাণ
আছে , মেয়ের বয়স সতেরো।
প্রবীণারা বলিলেন , “ কুষ্ঠিতে কি আর
ফাঁকি চলে না। ”
এই লইয়া ঘোর তর্ক , এমন-কি বিবাদ
হইয়া গেল।
এমন সময়ে সেখানে হৈম আসিয়া
উপস্থিত । কোনো-এক দিদিমা
জিজ্ঞাসা করিলেন , “ নাতবউ ,
তোমার বয়স কত বলো তো। ”
মা তাহাকে চোখ টিপিয়া ইশারা
করিলেন । হৈম তাহার অর্থ বুঝিল না ;
বলিল , “ সতেরো। ”
মা ব্যস্ত হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ তুমি
জান না। ”
হৈম কহিল , “ আমি জানি , আমার বয়স
সতেরো। ”
দিদিমারা পরস্পর গা-টেপাটেপি
করিলেন।
বধূর নির্বুদ্ধিতায় রাগিয়া উঠিয়া মা
বলিলেন, “ তুমি তো সব জান! তোমার
বাবা যে বলিলেন , তোমার বয়স
এগারো । ”
হৈম চমকিয়া কহিল, “ বাবা
বলিয়াছেন ? কখনো না। ”
মা কহিলেন , “ অবাক করিল । বেহাই
আমার সামনে নিজের মুখে বলিলেন ,
আর মেয়ে বলে ‘ কখনো না ' ! ” এই
বলিয়া আর-একবার চোখ টিপিলেন।
এবার হৈম ইশারার মানে বুঝিল; স্বর
আরো দৃঢ় করিয়া বলিল, “ বাবা এমন
কথা কখনোই বলিতে পারেন না। ”
মা গলা চড়াইয়া বলিলেন, “ তুই
আমাকে মিথ্যাবাদী বলিতে চাস? ”
হৈম বলিল, “ আমার বাবা তো কখনোই
মিথ্যা বলেন না। ”
ইহার পরে মা যতই গালি দিতে
লাগিলেন কথাটার কালি ততই গড়াইয়া
ছড়াইয়া চারি দিকে লেপিয়া গেল।
মা রাগ করিয়া বাবার কাছে তাঁহার
বধূর মূঢ়তা এবং ততোধিক একগুঁয়েমির
কথা বলিয়া দিলেন। বাবা হৈমকে
ডাকিয়া বলিলেন, “ আইবড় মেয়ের
মেয়ের বয়স সতেরো, এটা কি খুব একটা
গৌরবের কথা, তাই ঢাক পিটিয়া
বেড়াইতে হইবে? আমাদের এখানে এ-
সব চলিবে না, বলিয়া রাখিতেছি। ”
হায় রে, তাঁহার বউমার প্রতি বাবার
সেই মধুমাখা পঞ্চম স্বর আজ একেবারে
এমন বাজখাঁই খাদে নাবিল কেমন
করিয়া।
হৈম ব্যথিত হইয়া প্রশ্ন করিল, “ কেহ
যদি বয়স জিজ্ঞাসা করে কী বলিব। ”
বাবা বলিলেন, “ মিথ্যা বলিবার
দরকার নাই , তুমি বলিয়ো, ‘ আমি
জানি না; আমার শাশুড়ি জানেন ' । ”
কেমন করিয়া মিথ্যা বলিতে না হয়
সেই উপদেশ শুনিয়া হৈম এমন ভাবে চুপ
করিয়া রহিল যে বাবা বুঝিলেন,
তাঁহার সদুপদেশটা একেবারে বাজে
খরচ হইল।
হৈমর দুর্গতিতে দুঃখ করিব কী, তাহার
কাছে আমার মাথা হেঁট হইয়া গেল।
সেদিন দেখিলাম, শরৎপ্রভাতের
আকাশের মতো তাহার চোখের সেই
সরল উদার দৃষ্টি একটা কী সংশয়ে ম্লান
হইয়া গেছে । ভীত হরিণীর মতো সে
আমার মুখের দিকে চাহিল। ভাবিল, ‘
আমি ইহাদিগকে চিনি না। '
সেদিন একখানা শৌখিন-বাঁধাই-করা
ইংরাজি কবিতার বই তাহার জন্য
কিনিয়া আনিয়াছিলাম। বইখানি সে
হাতে করিয়া লইল এবং আস্তে আস্তে
কোলের উপর রাখিয়া দিল, একবার
খুলিয়া দেখিল না।
আমি তাহার হাতখানি তুলিয়া ধরিয়া
বলিলাম, “ হৈম , আমার উপর রাগ
করিয়ো না। আমি তোমার সত্যে কখনো
আঘাত করিব না। আমি যে তোমার
সত্যের বাঁধনে বাঁধা। ”
হৈম কিছু না বলিয়া একটুখানি হাসিল।
সে হাসি বিধাতা যাহাকে দিয়াছেন
তাহার কোনো কথা বলিবার দরকার
নাই।
পিতার আর্থিক উন্নতির পর হইতে
দেবতার অনুগ্রহকে স্থায়ী করিবার জন্য
নূতন উৎসাহে আমাদের বাড়িতে
পূজার্চনা চলিতেছে। এ-পর্যন্ত সে-
সমস্ত ক্রিয়াকর্মে বাড়ির বধূকে ডাক
পড়ে নাই। নূতন বধূর প্রতি একদিন পূজা
সাজাইবার আদেশ হইল ; সে বলিল, “
মা , বলিয়া দাও কী করিতে হইবে। ”
ইহাতে কাহারো মাথায় আকাশ
ভাঙিয়া পড়িবার কথা নয়, কারণ
সকলেরই জানা ছিল মাতৃহীন প্রবাসে
কন্যা মানুষ । কিন্তু, কেবলমাত্র হৈমকে
লজ্জিত করাই এই আদেশের হেতু।
সকলেই গালে হাত দিয়া বলিল , “ ওমা ,
এ কী কাণ্ড। এ কোন্ নাস্তিকের ঘরের
মেয়ে । এবার এ সংসার হইতে লক্ষ্মী
ছাড়িল, আর দেরি নাই। ”
এই উপলক্ষে হৈমর বাপের উদ্দেশে
যাহা-না-বলিবার তাহা বলা হইল।
যখন হইতে কটু কথার হাওয়া দিয়াছে
হৈম একেবারে চুপ করিয়া সমস্ত সহ্য
করিয়াছে। এক দিনের জন্য কাহারো
সামনে সে চোখের জলও ফেলে নাই।
আজ তাহার বড়ো বড়ো দুই চোখ
ভাসাইয়া দিয়া জল পড়িতে লাগিল।
সে উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “ আপনারা
জানেন- সে দেশে আমার বাবাকে
সকলে ঋষি বলে ? ”
ঋষি বলে! ভরি একটা হাসি পড়িয়া
গেল। ইহার পরে তাহার পিতার উল্লেখ
করিতে হইলে প্রায়ই বলা হইত তোমার
ঋষিবাবা! এই মেয়েটির সকলের চেয়ে
দরদের জায়গাটি যে কোথায় তাহা
আমাদের সংসার বুঝিয়া লইয়াছিল।
বস্তুত , আমার শ্বশুর ব্রাক্ষ্মও নন,
খৃস্টানও নন , হয়তো বা নাস্তিকও না
হইবেন। দেবার্চনার কথা কোনোদিন
তিনি চিন্তাও করেন নাই। মেয়েকে
তিনি অনেক পড়াইয়াছেন-শুনাইয়াছেন
, কিন্তু কোনোদিনের জন্য দেবতা
সম্বন্ধে তিনি তাহাকে কোনো
উপদেশ দেন নাই । বনমালীবাবু এ লইয়া
তাঁহাকে একবার প্রশ্ন করিয়াছিলেন।
তিনি বলিয়াছিলেন, “ আমি যাহা
বুঝি না তাহা শিখাইতে গেলে কেবল
কপটতা শেখানো হইবে। ”
অন্তঃপুরে হৈমর একটি প্রকৃত ভক্ত ছিল,
সে আমার ছোটো বোন নারানী।
বউদিদিকে ভালোবাসে বলিয়া
তাহাকে অনেক গঞ্জনা সহিতে
হইয়াছিল। সংসারযাত্রায় হৈমর সমস্ত
অপমানের পালা আমি তাহার কাছেই
শুনিতে পাইতাম। এক দিনের জন্যও
আমি হৈমর কাছে শুনি নাই। এ-সব কথা
সংকোচে সে মুখে আনিতে পারিত না।
সে সংকোচ নিজের জন্য নহে।
হৈম তাহার বাপের কাছ হইতে যত
চিঠি পাইত সমস্ত আমাকে পড়িতে
দিত। চিঠিগুলি ছোটো কিন্তু রসে
ভরা। সেও বাপকে যত চিঠি লিখিত
সমস্ত আমাকে দেখাইত। বাপের সঙ্গে
তাহার সম্বন্ধটি আমার সঙ্গে ভাগ
করিয়া না লইলে তাহার দাম্পত্য যে
পূর্ণ হইতে পারিত না। তাহার চিঠিতে
শ্বশুরবাড়ি সম্বন্ধে কোনো নালিশের
ইশারাটুকুও ছিল না। থাকিলে বিপদ
ঘটিতে পারিত। নারানীর কাছে
শুনিয়াছি , শ্বশুরবাড়ির কথা কী লেখে
জানিবার জন্য মাঝে মাঝে তাহার
চিঠি খোলা হইত।
চিঠির মধ্যে অপরাধের কোনো প্রমাণ
না পাইয়া উপরওয়ালাদের মন যে শান্ত
হইয়াছিল তাহা নহে। বোধ করি
তাহাতে তাঁহারা আশাভঙ্গের দুঃখই
পাইয়াছিলেন । বিষম বিরক্ত হইয়া
তাঁহারা বলিতে লাগিলেন, “ এত ঘন ঘন
চিঠিই বা কিসের জন্য। বাপই যেন সব ,
আমরা কি কেহ নই। ” এই লইয়া অনেক
অপ্রিয় কথা চলিতে লাগিল। আমি
ক্ষুব্ধ হইয়া হৈমকে বলিলাম , “ তোমার
বাবার চিঠি আর-কাহাকেও না দিয়া
আমাকেই দিয়ো। কলেজে যাইবার সময়
আমি পোস্ট করিয়া দিব। ”
হৈম বিস্মিত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “
কেন ? ”
আমি লজ্জায় তাহার উত্তর দিলাম না।
বাড়িতে এখন সকলে বলিতে আরম্ভ
করিল, “ এইবার অপুর মাথা খাওয়া হইল।
বি.এ. ডিগ্রি শিকায় তোলা রহিল।
ছেলেরই বা দোষ কী। ”
সে তো বটেই । দোষ সমস্তই হৈমর।
তাহার দোষ যে তাহার বয়স সতেরো ;
তাহার দোষ যে আমি তাহাকে
ভালোবাসি ; তাহার দোষ যে
বিধাতার এই বিধি , তাই আমার হৃদয়ের
রন্ধ্রে রন্ধ্রে সমস্ত আকাশ আজ বাঁশি
বাজাইতেছে।
বি.এ.ডিগ্রি অকাতরচিত্তে আমি চুলায়
দিতে পারিতাম কিন্তু হৈমর কল্যাণে
পণ করিলাম, পাস করিবই এবং ভালো
করিয়াই পাস করিব। এ পণ রক্ষা করা
আমার সে অবস্থায় যে সম্ভবপর বোধ
হইয়াছিল তাহার দুইটি কারণ ছিল — এক
তো হৈমর ভালোবাসার মধ্যে এমন
একটি আকাশের বিস্তার ছিল যে ,
সংকীর্ণ আসক্তির মধ্যে সে মনকে
জড়াইয়া রাখিত না, সেই
ভালোবাসার চারি দিকে ভারি একটি
স্বাস্থ্যকর হাওয়া বহিত। দ্বিতীয় ,
পরীক্ষার জন্য যে বইগুলি পড়ার
প্রয়োজন তাহা হৈমর সঙ্গে একত্রে
মিলিয়া পড়া অসম্ভব ছিল না।
পরীক্ষা পাসের উদ্যোগে কোমর
বাঁধিয়া লাগিলাম। একদিন রবিবার
মধ্যাহ্নে বাহিরের ঘরে বসিয়া
মার্টিনোর চরিত্রতত্ত্ব বইখানার
বিশেষ বিশেষ লাইনের মধ্যপথগুলা
ফাড়িয়া ফেলিয়া নীল পেন্সিলের
লাঙল চালাইতেছিলাম, এমন সময়
বাহিরের দিকে হঠাৎ আমার চোখ
পড়িল।
আমার ঘরের সমুখে আঙিনার উত্তর
দিকে অন্তঃপুরে উঠিবার একটা সিঁড়ি।
তাহারই গায়ে গায়ে মাঝে মাঝে
গরাদে-দেওয়া এক-একটা জানলা।
দেখি, তাহারই একটি জানলায় হৈম চুপ
করিয়া বসিয়া পশ্চিমের দিকে
চাহিয়া। সে দিকে মল্লিকদের
বাগানে কাঞ্চনগাছ গোলাপি ফুলে
আচ্ছন্ন।
আমার বুকে ধক্ করিয়া একটা ধাক্কা
দিল; মনের মধ্যে একটা অনবধানতার
আবরণ ছিঁড়িয়া পড়িয়া গেল। এই
নিঃশব্দ গভীর বেদনার রূপটি আমি
এতদিন এমন স্পষ্ট করিয়া দেখি নাই।
কিছু না , আমি কেবল তাহার বসিবার
ভঙ্গিটুকু দেখিতে পাইতেছিলাম।
কোলের উপরে একটি হাতের উপর আর-
একটি হাত স্থির পড়িয়া আছে ,
মাথাটি দেয়ালের উপরে হেলানো ,
খোলা চুল বাম কাঁধের উপর দিয়া বুকের
উপর ঝুলিয়া পড়িয়াছে । আমার বুকের
ভিতরটা হুহু করিয়া উঠিল।
আমার নিজের জীবনটা এমনি কানায়
কানায় ভরিয়াছে যে , আমি কোথাও
কোনো শূন্যতা লক্ষ করিতে পারি নাই।
আজ হঠাৎ আমার অত্যন্ত নিকটে অতি
বৃহৎ একটা নৈরাশ্যের গহ্বর দেখিতে
পাইলাম। কেমন করিয়া কী দিয়া আমি
তাহা পূরণ করিব।
আমাকে তো কিছুই ছাড়িতে হয় নাই।
না আত্মীয়, না অভ্যাস, না কিছু। হৈম
যে সমস্ত ফেলিয়া আমার কাছে
আসিয়াছে। সেটা কতখানি তাহা
আমি ভালো করিয়া ভাবি নাই।
আমাদের সংসারে অপমানের
কণ্টকশয়নে সে বসিয়া; সে শয়ন আমিও
তাহার সঙ্গে ভাগ করিয়া লইয়াছি।
সেই দুঃখে হৈমর সঙ্গে আমার যোগ
ছিল, তাহাতে আমাদিগকে পৃথক করে
নাই। কিন্তু , এই গিরিনন্দিনী সতেরো-
বৎসর-কাল অন্তরে বাহিরে কত বড়ো
একটা মুক্তির মধ্যে মানুষ হইয়াছে। কী
নির্মল সত্যে এবং উদার আলোকে
তাহার প্রকৃতি এমন ঋজু শুভ্র ও সবল
হইয়া উঠিয়াছে। তাহা হইতে হৈম যে
কিরূপ নিরতিশয় ও নিষ্ঠুররূপে বিচ্ছিন্ন
হইয়াছে এতদিন তাহা আমি সম্পূর্ণ
অনুভব করিতে পারি নাই , কেননা
সেখানে তাহার সঙ্গে আমার সমান
আসন ছিল না।
হৈম যে অন্তরে অন্তরে মুহূর্তে মুহূর্তে
মরিতেছিল। তাহাকে আমি সব দিতে
পারি কিন্তু মুক্তি দিতে পারি না —
তাহা আমার নিজের মধ্যে কোথায়?
সেইজন্যই কলিকাতার গলিতে ঐ
গরাদের ফাঁক দিয়া নির্বাক্ আকাশের
সঙ্গে তাহার নির্বাক্ মনের কথা হয়;
এবং এক-একদিন রাত্রে হঠাৎ জাগিয়া
উঠিয়া দেখি সে বিছানায় নাই,
হাতের উপর মাথা রাখিয়া আকাশ-
ভরা তারার দিকে মুখ তুলিয়া ছাতে
শুইয়া আছে।
মার্টিনো পড়িয়া রহিল। ভাবিতে
লাগিলাম, কী করি। শিশুকাল হইতে
বাবার কাছে আমার সংকোচের অন্ত
ছিল না— কখনো মুখোমুখি তাঁহার
কাছে দরবার করিবার সাহস বা অভ্যাস
আমার ছিল না। সেদিন থাকিতে
পারিলাম না। লজ্জার মাথা খাইয়া
তাঁহাকে বলিয়া বসিলাম, “ বউয়ের
শরীর ভালো নয় , তাহাকে একবার
বাপের কাছে পাঠাইলে হয়।”
বাবা তো একেবারে হতবুদ্ধি। মনে
লেশমাত্র সন্দেহ রহিল না যে, হৈমই
এরূপ অভূতপূর্ব স্পর্ধায় আমাকে
প্রবর্তিত করিয়াছে। তখনই তিনি
উঠিয়া অন্তঃপুরে গিয়া হৈমকে
জিজ্ঞাসা করিলেন, “ বলি বউমা ,
তোমার অসুখটা কিসের। ”
হৈম বলিল, “ অসুখ তো নাই। ”
বাবা ভাবিলেন, এ উত্তরটা তেজ
দেখাইবার জন্য।
কিন্তু , হৈমর শরীরও যে দিনে দিনে
শুকাইয়া যাইতেছিল তাহা আমরা
প্রতিদিনের অভ্যাসবশতই বুঝি নাই।
একদিন বনমালীবাবু তাহাকে দেখিয়া
চমকিয়া উঠিলেন, “ অ্যাঁ , এ কী। হৈমী ,
এ কেমন চেহারা তোর! অসুখ করে নাই
তো ?”
হৈম কহিল, “ না। ”
এই ঘটনার দিন-দশেক পরেই , বলা নাই ,
কহা নাই , হঠাৎ আমার শ্বশুর আসিয়া
উপস্থিত। হৈমর শরীরের কথাটা নিশ্চয়
বনমালীবাবু তাঁহাকে লিখিয়াছিলেন।
বিবাহের পর বাপের কাছে বিদায়
লইবার সময় মেয়ে আপনার অশ্রু চাপিয়া
নিয়াছিল। এবার মিলনের দিন বাপ
যেমনি তাহার চিবুক ধরিয়া মুখটি
তুলিয়া ধরিলেন অমনি হৈমর চোখের
জল আর মানা মানিল না। বাপ একটি
কথা বলিতে পারিলেন না; জিজ্ঞাসা
পর্যন্ত করিলেন না ‘ কেমন আছিস '।
আমার শ্বশুর তাঁহার মেয়ের মুখে এমন-
একটা কিছু দেখিয়াছিলেন যাহাতে
তাঁহার বুক ফাটিয়া গেল।
হৈম বাবার হাত ধরিয়া তাঁহাকে
শোবার ঘরে লইয়া গেল । অনেক কথা
যে জিজ্ঞাসা করিবার আছে । তাহার
বাবারও যে শরীর ভালো দেখাইতেছে
না।
বাবা জিজ্ঞাসা করিলেন , “ বুড়ি ,
আমার সঙ্গে যাবি ? ”
হৈম কাঙালের মতো বলিয়া উঠিল , “
যাব। ”
বাপ বলিলেন , “ আচ্ছা , সব ঠিক
করিতেছি। ”
শ্বশুর যদি অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হইয়া না
থাকিতেন তাহা হইলে এ বাড়িতে
ঢুকিয়াই বুঝিতে পারিতেন, এখানে
তাঁহার আর সেদিন
নাই। হঠাৎ তাঁহার আবির্ভাবকে উপদ্রব
মনে করিয়া বাবা তো ভালো করিয়া
কথাই কহিলেন না। আমার শ্বশুরের
মনে ছিল তাঁহার বেহাই একদা
তাঁহাকে বার বার করিয়া আশ্বাস
দিয়াছিলেন যে, যখন তাঁহার খুশি
মেয়েকে তিনি বাড়ি লইয়া যাইতে
পারিবেন। এ সত্যের অন্যথা হইতে
পারে সে কথা তিনি মনেও আনিতে
পারেন নাই।
বাবা তামাক টানিতে টানিতে
বলিলেন, “ বেহাই , আমি তো কিছু
বলিতে পারি না, একবার তা হলে
বাড়ির মধ্যে — ”
বাড়ির-মধ্যের উপর বরাত দেওয়ার অর্থ
কী আমার জানা ছিল। বুঝিলাম, কিছু
হইবে না। কিছু হইলও না।
বউমার শরীর ভালো নাই! এত বড়ো
অন্যায় অপবাদ!
শ্বশুরমশায় স্বয়ং একজন ভালো
ডাক্তার আনিয়া পরীক্ষা করাইলেন।
ডাক্তার বলিলেন, “ বায়ু-পরিবর্তন
আবশ্যক, নহিলে হঠাৎ একটা শক্ত
ব্যামো হইতে পারে। ”
বাবা হাসিয়া কহিলেন, “ হঠাৎ একটা
শক্ত ব্যামো তো সকলেরই হইতে পারে।
এটা কি আবার একটা কথা। ”
আমার শ্বশুর কহিলেন, “ জানেন তো ,
উনি একজন প্রসিদ্ধ ডাক্তার, উহার
কথাটা কি —”
বাবা কহিলেন, “ অমন ঢের ডাক্তার
দেখিয়াছি। দক্ষিণার জোরে সকল
পণ্ডিতেরই কাছে সব বিধান মেলে
এবং সকল ডাক্তারেরই কাছে সব
রোগের সার্টিফিকেট পাওয়া যায়! ”
এই কথাটা শুনিয়া আমার শ্বশুর
একেবারে স্তব্ধ হইয়া গেলেন। হৈম
বুঝিল তাহার বাবার প্রস্তাব
অপমানের সহিত অগ্রাহ্য হইয়াছে।
তাহার মন একেবারে কাঠ হইয়া গেল।
আমি আর সহিতে পরিলাম না। বাবার
কাছে গিয়া বলিলাম, “ হৈমকে আমি
লইয়া যাইব। ”
বাবা গর্জিয়া উঠিলেন, “ বটে রে — ”
ইত্যাদি ইত্যাদি।
বন্ধুরা কেহ কেহ আমাকে জিজ্ঞাসা
করিয়াছেন, যাহা বলিলাম তাহা
করিলাম না কেন। স্ত্রীকে লইয়া জোর
করিয়া বাহির হইয়া গেলেই তো হইত।
গেলাম না কেন? কেন! যদি লোকধর্মের
কাছে সত্যধর্মকে না ঠেলিব যদি ঘরের
কাছে ঘরের মানুষকে বলি দিতে না
পারিব, তবে আমার রক্তের মধ্যে
বহুযুগের যে শিক্ষা তাহা কী করিতে
আছে। জান তোমরা? যেদিন অযোধ্যার
লোকেরা সীতাকে বিসর্জন দিবার
দাবি করিয়াছিল তাহার মধ্যে আমিও
যে ছিলাম। আর সেই বিসর্জনের
গৌরবের কথা যুগে যুগে যাহারা গান
করিয়া আসিয়াছে আমিও যে তাহাদের
মধ্যে একজন। আর , আমিই তো সেদিন
লোকরঞ্জনের জন্য স্ত্রীপরিত্যাগের
গুণবর্ণনা করিয়া মাসিকপত্রে প্রবন্ধ
লিখিয়াছি। বুকের রক্ত দিয়া আমাকে
যে একদিন দ্বিতীয় সীতাবিসর্জনের
কাহিনী লিখিতে হইবে , সে কথা কে
জানিত।
পিতায় কন্যায় আর-একবার বিদায়ের
ক্ষণ উপস্থিত হইল। এইবারেও দুইজনেরই
মুখে হাসি। কন্যা হাসিতে হাসিতেই
ভর্ৎসনা করিয়া বলিল, “ বাবা, আর যদি
কখনো তুমি আমাকে দেখিবার জন্য এমন
ছুটাছুটি করিয়া এ বাড়িতে আস তবে
আমি ঘরে কপাট দিব। ”
বাপ হাসিতে হাসিতেই বলিলেন, “
ফের যদি আসি তবে সিঁধকাটি সঙ্গে
করিয়াই আসিব। ”
ইহার পরে হৈমর মুখে তাহার
চিরদিনের সেই স্নিগ্ধ হাসিটুকু আর
একদিনের জন্যও দেখি নাই।
তাহারও পরে কী হইল সে কথা আর
বলিতে পারিব না।
শুনিতেছি, মা পাত্রী সন্ধান
করিতেছেন । হয়তো একদিন মার
অনুরোধ অগ্রাহ্য করিতে পারিব না ,
ইহাও সম্ভব হইতে পারে। কারণ — থাক্,
আর কাজ কী!
হৈমন্তী (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) হৈমন্তী (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) Reviewed by Unknown on January 01, 2016 Rating: 5

No comments:

AR.RoMaN. Theme images by imagedepotpro. Powered by Blogger.